ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

বিদ্যালয় নিয়ে আমার ভাবনা: কানিস ফাতেমা রিমা

মতামত

২০২৪-০৯-১৬ ১৪:৩৩:৪৬ /


প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি, একটি শিশুর শিশুকালের সবচেয়ে কোমল ও কঠিন সময়। শিশুর মায়ের কোল থেকে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখার প্রথম সোপান আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী আমি ছিলাম। কারণ, আমার বাবা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে আমি গভীরভাবে অবগত আছি। তাই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। প্রাথমিক শিক্ষা কোন দেশের জাতি গঠনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

শিশুকাল মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়। কোমল শিশুর মন তখন থাকে কাঁদামাটির মতো। তাকে তখন যেভাবে গড়া যাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার জীবনটা সে দিকেই ধাবিত হবে। এরকম একজন শিশুর হাত ধরেই এগিয়ে যাবে পুরো সমাজ, জাতি তথা দেশ। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার ভায়াডাঙ্গা টেংগরপাড়া প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে এখানেও শুরু হয়েছে উন্নয়নের ছোঁয়া। কেননা সরকার অবৈতনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ উপবৃত্তি, নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই
নিশ্চিত করেছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলোর বিষয়বস্তু এতো আনন্দদায়ক এত প্রাঞ্জল এবং বস্তু নিষ্ঠ যে,বাচ্চারা একে অন্যের সঙ্গে খেলতে খেলতে তা শিখতে পারে। শিশুদের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার এই পাঠ্যক্রম শিশুদের চিন্তা করতে শেখায়, সৃজনশীল শেখায় এবং মনের অজান্তেই শেখায় নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এবং সোহার্দ্য ও সম্প্রীতি। আমার বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ থাকায় শিশুরা স্কুল শুরু হওয়ার অনেক আগে আসে। বিদ্যালয়ে খেলাধূলার উপকরণ আছে, সেখান থেকে সহজে বাসায় যেতে চায় না। তবুও আমার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম।

তার অনেক বড় একটা কারণ অভিভাবকের অসচেতনতা। তারা বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করেন কিন্তু আর কোন খোঁজ-খবর নেন না। হাঁড় কাপানো শীতেও শিশুদের গাঁয়ে শীতের কাপড় নেই, স্কুল ড্রেস নেই। ওদের জিজ্ঞেস করলেই বলে যে, স্কুল ড্রেস বানাতে দিয়েছে অথবা ভেজা। তার মানে বাবা-মা উদাসীন আবার অনেক অভিভাবক ভাবেন, সরকারি স্কুল এত নিয়ম-কানুন কী? এর অনেক বড় একটা কারণ এরা নিজেরা পড়াশোনা করেনি। জ্ঞাণের যে আলো মনকে প্রজ্বলিত করে, মনের অন্ধকার গুহার তালা খুলে দেয়, সেই আলোর স্পর্শ তারা পায়নি।

তাদের নিজের জীবনে কোন স্বপ্ন নেই, লক্ষ্য নেই। তাদের বাচ্চারাও তাই সেই স্বপ্নবিহীন জীবন কাটায়। কারণ স্বপ্ন ও দেখা শিখতে হয়। বাবা-মার স্বপ্ন ক্রমে পুঞ্জীভূত হয় শিশুর মনে। অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠকে অভিভাবকদের নিয়ে কথা বললে মনে হয় স্কুলে দিতে হয় তাই তারা শিশুকে স্কুলে পাঠায়। এরপর আর তাদের কোন দায় নেই। হোম ভিজিট করে মা সমাবেশ করে অভিভাবকদের কত বুঝাই, কত স্বপ্ন দেখাই কিছুতেই কিছু হয় না।

ভাবতে থাকি এর থেকে উত্তরনের উপায় কী? মনে হলো একমাত্র শিক্ষকরাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। স্কুলটা, ক্লাশটা যদি তাকে চুম্বকের মতো টানে, তবেই আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো স্কুলের ঘন্টার শব্দ শুনলেই শিশুরা সব কাজ ফেলে স্কুলে দৌড় দেবে।

শিক্ষক-ছাত্র এ সম্পর্কটা যতদিন গাঢ় না হবে ততদিন প্রাথমিক শিক্ষার ভীত মজবুত হবে না। মজবুত হতে হলে শিক্ষককে সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে ছাত্রদের। শিশুরা খুব ভালোবাসা বোঝে। আমি যদি তাকে নিয়ে ভাবি, স্বপ্ন দেখি সে অবশ্যই স্কুলে আসবে। একজন শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবনের মডেল হয়ে উঠতে পারে।

বিদ্যালয়কে সু-সজ্জিত ও আকর্ষন করে মনোরম পরিবেশে যদি পাঠদানের ব্যবস্থা করা যায়, তবেই শিক্ষার্থী উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে। এ ভাবনা থেকেই আমার বিদ্যালয়কে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহযোগীতা নিয়ে আমার নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়কে আকর্ষনীয় ও সুসজ্জিত করার লক্ষ্যে অফিস কক্ষ, ক্লাশ রুম ও সম্মুখে একটি ফুল বাগান ও বৃক্ষ তথা ঔষধী বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে।

আমার বিদ্যালয়ে ফুটবল প্রতিযোগীতায় মেয়েদল প্রথমবারের মত উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে জেলা পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিল। এটা আমার বিদ্যালয়ের জন্য বিরল সম্মানের। বিদ্যালয়ের পাশেই আমার বাড়ি হওয়াতে, ওদের জন্য বাড়তি সময় দিয়েছি, বাড়িতে এনে অনুশীলন করিয়েছি। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহায়তায় কোচ দিয়ে কোচিং এর ব্যবস্থা করেছি। ওদের সুবিধা-অসুবিধা দেখেছি, সর্বোপরী ওদের মনে একটি জেদ তৈরি করেছি। এ জেদটারই বড় অভাব। শিক্ষক যদি তার জীবনের অপূর্ণ জেদটা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গেথে দিতে পারে তবেই সে স্বার্থক।

স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্মার্ট নাগরিক তাদের সিংহভাগই কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার্থী। স্মার্ট অর্থনীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মানে তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। জানি না, আমার বিদ্যালয় নিয়ে আমার ভাবনা আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে কি না। তবে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি সকলের আন্তরিকতায় একদিন বিদ্যালয় নিয়ে আমার স্বপ্ন ও ভাবনা গুলো অবশ্যই পূরণ হবে ইনশা-আল্লাহ। সেই প্রতিক্ষায়-------।

লেখক : কানিস ফাতেমা রিমা, সহকারী শিক্ষক, টেংগরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ভায়াডাঙ্গা, শ্রীবরদী, শেরপুর।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা চাই

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা চাই

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকায় শিক্ষকের ভূমিকা

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকায় শিক্ষকের ভূমিকা

অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ বছর হলে বেকারত্বের হার মারাত্মক হবে

অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ বছর হলে বেকারত্বের হার মারাত্মক হবে