২০২৫-১০-০৫ ১৯:৫৩:৪১ / Print
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব ব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান রক্ষা এবং সমাজে তাদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়।
ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রতি বছর ৫ অক্টোবর ঘটা করে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হয়। এই দিবসে বক্তারা শিক্ষকদের মান-মর্যাদা বৃদ্ধিসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক, কলামিস্টরা শিক্ষকদের পক্ষে পত্রিকায় লেখালেখি করেন। কিন্তু শিক্ষক দিবস চলে গেলে শিক্ষকদের কথা আর কেউ মনে রাখে না। যারা এখন সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরাও যে কোনো না কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পড়েছেন সেটাও তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। এমনকি শিক্ষকদের খাটো করে কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি:
এক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পাত্রের কাছে অনেক অভিভাবক তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইতেন না। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতন পেতেন তাতে সচ্ছলতার সাথে একটি সংসার চালানো কঠিন ছিল। ৮ম জাতীয় বেতন স্কেল নির্ধারণ করার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শিক্ষকদের জীবনমান বর্তমানে নিম্নমুখী । শিক্ষক নেতারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে বার বার গেলেও আশ্বাস দেয়া ছাড়া কোনো দাবি এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
পেশাগত মর্যাদা :
মহামান্য হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদেরকে পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি (১০ম) গ্রেড ঘোষণা করা হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এই সুযোগে কিছু শিক্ষক নামধারী দালাল শিক্ষকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকেই আবার সকল প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড পাওয়ার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপেই সহকারী শিক্ষকদের বেতন-স্কেল নির্ধারণ করার দাবি জানিয়ে আসলেও কর্তৃপক্ষ তাতে সারা দেয়নি।ফলে প্রধান শিক্ষকের সাথে সহকারী শিক্ষকদের ব্যাপক বেতন-বৈষম্য দেখা দিয়েছে। যার ফলে সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। কর্তৃপক্ষের অনেক সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে বার বার মামলা হচ্ছে। যার জন্য সরকার কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারছে না। শুধু তাই নয়, মামলার প্রায় সবগুলো রায় সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বড় বাঁধা তৈরি হচ্ছে।
পদোন্নতি :
সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ পদোন্নতির দাবি থাকলেও সরকার শেষ পর্যন্ত ৮০% পদোন্নতি দিতে রাজি হয়েছে। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু মামলা জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ পদোন্নতি স্থগিত রয়েছে। অনেকেই পদোন্নতির আশায় থেকে অবসরে চলে গেছেন।
সহকারী শিক্ষকদের চলতি দায়িত্ব দিয়ে প্রধান শিক্ষককের মর্যাদা দেয়া হলেও তাদের এখনো পর্যন্ত পদোন্নতি দেয়া হয়নি। যার ফলে, পুরাতন প্রধান শিক্ষক ও চলতি দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে মর্যাদার লড়াই তৈরি হয়েছে যা প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে বড় বাধা।
নীতিমালা না মেনে বদলি প্রদান:-
অনলাইন প্রাথমিক শিক্ষক বদলি নীতিমালা তৈরি হলেও নীতিমালা অনুযায়ী বদলি হচ্ছে না। কর্মরত বিদ্যালয়ের কর্মকাল গণনা করে ৩০ নম্বরের মধ্যে স্কোর নির্ধারণের নির্দেশনা থাকলেও চাকরির প্রথম যোগদানের তারিখ থেকে কর্মকাল গণনার কারণে সিনিয়র শিক্ষকরা বাড়ীর কাছে চাকরি করেও বাব বার বদলি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। অপরদিকে একই বিদ্যালয়ে কর্মকাল বেশি থাকা এবং দূরের বিদ্যালয়ে চাকরি করা সত্ত্বেও অন্য শিক্ষকরা বদলি হতে পারছেনা। শুধু তাই নয় অনেকেই যেকোন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সাবমিট করে ভুয়া প্রতিবন্ধী দেখিয়ে প্রতিবন্ধীকতার জন্য নির্ধারণকৃত ১০ স্কোর মোট স্কোরের সাথে যোগ করিয়ে নিচ্ছেন।এখনো অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৩/৪ জন করে শিক্ষক কর্মরত আছেন। যার ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা কাঙ্ক্ষিত স্থানে বদলি হতে পারছে না। ঘুষ,দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখার জন্যই অনলাইন বদলি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু নীতিমালা না মেনে বদলি কার্যক্রম পরিচালনা করায় উদ্দেশ্য বিফলে যাচ্ছে।
৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার জটিলতা :
প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েও সরকার তা বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রমতে, বাংলাদেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭২৯টি বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চালু আছে। বাকীগুলোতে ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হচ্ছে। যেসব বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালু আছে সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।কারণ একই বেতনে চাকরি করে তাঁদেরকে বাড়তি তিনটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াতে হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত তিনটি শ্রেণির জন্য কোন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।কমসংখ্যক শিক্ষক নিয়ে মানসম্মত পাঠদান করা খুবই কঠিন কাজ।শুধু তাই নয় অনেক বিদ্যালয়ে অফিস সহায়ক নেই। তাই সারা দেশে যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নিত করা সম্ভব না হয় তাহলে যেগুলোতে চালু আছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন।
পরিশেষে বলব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার মূল ভিত্তি রচনা করে। অথচ তাঁরা এখনও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী তাই আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করে সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদা বাড়ানোর মাধ্যমে উপরোক্ত সমস্যাবলী চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন অবশ্যই সম্ভব।
লেখক: ফরিদ আহাম্মদ,শিক্ষক ও কলামিস্ট,সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, নালিতাবাড়ী, শেরপুর। Chief Admin: PTG - Primary Teachers Guild. (Facebook Group)
ই-মেইল : faridptg110@gmail.com