২০২৫-১০-২৭ ১১:৪৮:৩৬ / Print
আমরা শিক্ষক, আমাদের কাজ কী!
আমি একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করি, আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে যা এড়িয়ে যেতে পারিনা। তবে হ্যাঁ আমরা সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও আচরণকে নিক্তিতে বিচার করলে দেখতে পাই, দেশের যতগুলো সেক্টর/ডিপার্টমেন্ট/খাত আছে তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
সেইসাথে বাজেটে ও কম বরাদ্দ দেয়া হয় যা একটি দেশের জন্য আত্মঘাতী বিষয়ও বটে। অথচ একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো স্বাস্থ্য আর মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। বিশ্বাস না হলে একবার করোনাকালীন সময়টাকে অনুভব করে দেখতে পারেন। হিসেবটা নিশ্চিত মিলে যাবে। এবার আসি শিক্ষকদের বিষয়ে। তাদের হয়তো কিছুটা সম্মান দেয়া হয় কিন্তু সেটা বজায় রাখতে সে পরিমান অর্থ দেয়া হয়না যা দিয়ে সে আত্মমর্যাদার সাথে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। খালি সম্মান দিয়েতো আর পেট ভরেনা। যে যাই বলুক, দিনশেষে একটু ভাল থাকার জন্য টাকা লাগবেই।
তবুও আমি বলব আমাদের শ্রেণিকক্ষে একটু সিরিয়াস হই। সবাই আমরা শিক্ষকরা একে অপরকে কামড়াকামড়ি না করে কিংবা দোষারোপ না করে নিজেরাই নিজেকে প্রশ্ন করি। এ দেশকে কিংবা জাতিকে আমি কতটা দিতে পেরেছি? চলুন নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করি সবটা দিয়ে। আমরাতো সবাই অনেক শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবাই প্রায়ই স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স। আসুন না শ্রেণিকক্ষে শিখন কার্যক্রমে একটু আন্তরিক হই। পাঠ্য বই এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একটু বেসিক জ্ঞান গুলো দেয়ার চেষ্টা করি। শিক্ষার্থী গুলো তো সব আমাদেরই তাইনা। আপনার আমার সবার বাচ্চাগুলো তো কারো না কারো শিক্ষার্থী। আপনি না শেখালে আপনার বাচ্চাটাকেওতো আর কেও শেখাবেননা, তাইনা।
আপনিতো শিক্ষক, জাতির বিবেক। সো বিবেক খাটিয়ে চলুন। শিক্ষার্থীদের মোরালিটি শিক্ষা দিন। নয়তো একটা সময় বিবেকের কাঠগড়ায় আপনাকেই দাঁড়াতে হবে। পরকালে অন্ত:ত জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে মুক্তি পাবেন। কারন কেয়ামতের দিন আপনার জীবন যাপন, আয় রোজগার সবকিছুর ই প্রতিদান পাবেন। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। সে দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন তার জবাবদিহি আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীকে মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য করে দিয়েছেন। আর এর সঠিক তদারকি করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব মানুষেরই। ভাবুনতো একজন ডক্টর যদি রোগী নিয়ে গবেষণা করে, একজন ইন্জিনিয়ার যদি বিল্ডিং ডিজাইন নিয়ে এমনকি ইট বালু সিমেন্ট নিয়ে গবেষণা করে, একজন এ্যাডভোকেট যদি আইন নিয়ে রিসার্চ করে তবে একজন শিক্ষক কেন মানুষের শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করবেনা!
তাই সকল পর্যায়ের শিক্ষক দের উদ্দেশ্যে বলি, আসুন। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করি, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবি, নতুন কিছু করার চিন্তা করি। আপনি আমি শিক্ষক সমাজ সিরিয়াস হলে শিক্ষার আমূল পরিবর্তন হবে। জাতির উন্নয়ন হবে। আর অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলি, দয়া করে শিক্ষকদের সম্মান দিয়ে কথা বলুন। অভিযোগ দেয়া ছেড়ে দিয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করুন। আপনার সন্তানটি তার সিংহভাগ সময়টাই কিন্তু শিক্ষকদের সংস্পর্শেই থাকে। এমন কিছু আচরণ করবেননা যার প্রভাব আপনাদের সন্তানটির উপর পড়ে। কারন বাবা মা এর পর কিন্তু শিক্ষকেরই অবস্থান।
তাছাড়া আপনার সন্তানের একটা বিশ্বাস, ভালবাসা ও আস্থার জায়গা হলো তার শিক্ষক। যদি কোন শিক্ষক কে কোনভাবে আঘাত দেন কিংবা আঙ্গুল তুলে কথা বলেন, হয়তো আপনার সামনে মুখ ফুটে বলেনা কিন্তু ভেতর ভেতর সে মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মনে রাখবেন আপনার সম্মান করা দেখে বাচ্চারাও শিক্ষকদের সম্মান করতে শেখে। কারন তারা যা দেখবে তাই তার আচরণে প্রভাব পড়বে।
আবারও আসা যাক শিক্ষক প্রসঙ্গে, শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি আপনার কোন ব্যক্তিগত রাগ কিংবা কোন প্রকার ক্ষোভ যেন কোন শিক্ষার্থীর উপর না পড়ে। ওরাকে নিজের সন্তানের মত করেই আমাদের লালন করতে হয়। কুরআনে সুরা জিলজাল এর ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তাও দেখতে পাবে। নিজ ভূমি বা দেশের প্রতি সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাহীন। দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই বেতনে শিক্ষক রা নতুন কিছু করতে উৎসাহ পায়না, কারন তাদের সংসারে সবসময়ের জন্য টানাপোড়েনের টেনশন, ঋণের বোঝা, ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউশনি, বাবা-মা সহ সংসারের সকলের চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে তারা ডিমোটিভেটেড হয়ে যায়। নিজের একটা স্বপ্নের বাড়ি করার চিন্তাতো বাদই দিলাম। তাহলে এসব হতাশা নিয়ে একজন শিক্ষক একাগ্রচিত্তে শিক্ষার্থীদের উপর কিভাবে মনোনিবেশ করবে, বলতে পারেন! এহেন পরিস্থিতে কখনই একজন সুস্থ মস্তিষ্কের শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে তাঁর সবটা দিতে পারবেনা। আর এজন্যই কিছু মেধাবীরা নিয়োগ পেলেও একটু বেশি বেতনের চাকরি পেলেই সম্মানের তোয়াক্কা না করেই এই পেশা ছেড়ে চলে যায়। আর যারা থেকে যায় তারা হীনমন্যতায় ভুগে এমনকি যে পরিবেশে লাইফ লীড করে সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কোন না কোন ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরে শিক্ষার উন্নয়ন থেকে ছিটকে পড়ে সেই শিক্ষক।
আপনি মানেন আর নাই মানেন এটাই বাস্তব। সেদিক থেকে বলতে গেলে এই উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টির মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর উন্নয়ন। সেজন্য বহুদিন থেকেই আমি এমনকি আমরা শিক্ষকগণ সরকার ও উর্ধ্বতন কর্মকতাদের বুঝিয়ে আসছি বেতন আকর্ষণীয় করুন। শুরুতেও যা বলেছিলাম আজও তাই বলছি সকল শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি এমন করুন যাতে মেধাবীরা তাদের প্রথম চয়েসে রাখে শিক্ষকতা পেশা।
আকর্ষণীয় বেতন পেলে মেধাবীরা শিক্ষক হতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আগামী ৫ বছরে সব মেধাবীরাই নিয়োগ পাবে। সেদিন দেখবেন মেধাবী শিক্ষকগণ মেধাবী জাতি উপহার দেবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! যারা পরিকল্পনার সাথে জড়িত তারা হয়তো জানেইনা শিক্ষকদের সামাজিক দূর্দশা কি! এমনকি খবরই রাখেনা তাদের সাংসারিক টানাপোড়েন আর হীনমন্যতার দরুন শ্রেণিকক্ষের শিখন কার্যক্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আসল রহস্য কোথায়! যদি জানতো কিংবা মানতো তাহলে সমমানের যোগ্যতায় অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো করার কথা বলতে গিয়ে আপমান আর সোকজ খেতে হতোনা।
বেতনের সামান্য কটা টাকা বাড়িয়ে একটু স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপনের জন্য লাখো শিক্ষকদেরকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে হতোনা! অথচ একটু প্রাইভেট কিংবা কোচিং করালে নিষেধাজ্ঞা দিতে দ্বিধা করেনা যেখানে ডক্টরদের ২ মিনিটে রোগী ১ থেকে ২ হাজার টাকা ফি নিতে কিংবা ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করলেও কোন নিষেধাজ্ঞা আসেনা। তাহলে শিক্ষরা প্র্যাকটিস করবে কোথায়, জানতে খুব ইচ্ছে করে। দেশটাতো কারো একার নয় বরং একদেশে এক নিয়মই থাকা উচিত। এখানে কি সবার সমান অধিকার থাকা বাঞ্চনীয় নয়! নাকি শিক্ষকদের ভাল থাকতে মানা। নাকি শিক্ষকদের ছোটলোক দেখতেই আমরা অভ্যস্ত, ওভাবেই থাকতে হবে তাদের। মাঝেমাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় আমরা কি সরকারের দরিদ্র শিক্ষক নাকি দরিদ্র শিক্ষকের দরিদ্র সরকারের মানসিকতা!
যে শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকের কোন ভূমিকা নেই! তাই যদি হয় তাহলে আমরা এত উচ্চাভিলাষী কেন! শিক্ষার মান উন্নয়ন না হলে কখনো কাঙ্খিত অর্জন সম্ভব নয় আর কিছু হলেও তা টেকসই উন্নয়ন হবেনা। আর শিক্ষকের মান উন্নয়ন না হলে শিক্ষাও উন্নত হবেনা। একথা বুঝতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে এই জাতিকে বলতে পারেন? বীনতভাবে অনুরোধ জানাই, শিক্ষা খাতকে ব্যায়ের খাত মনে না করে সেবার খাত মনে করুন। এটি একটি ইনভেস্টও বটে। ফলাফল অনিবার্য।
অতএব শিক্ষকদের মন চাঙ্গা রাখুন, তাদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে আকর্ষণীয় করে তুলুন। তারপর যত পারেন দায়িত্ব বাড়িয়ে দিন। দেখবেন শিক্ষার আমূল বিপ্লব ঘটবে। অন্যথায় দেশের শুধু বড় বড় বিল্ডিং হবে, কিন্তু উন্নত মেধাবী জাতি তৈরি হবেনা। নইলে এভাবে চলতে থাকলে একদিন এই দেশ এই জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। সেদিন দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে, এ আমার বিশ্বাস।
পরিশেষে আমি এটাই বলব, শিক্ষকদের বেতন আকর্ষণীয় করুন, মেধাবী শিক্ষক নিয়ে আসুন মেধাবী জাতি উপহার পাবেন ইনশাআল্লাহ।
লেখক: আলহাজ্ব সাখাওয়াত হোসেন সৈকত,শিক্ষক, কবি ও বাচিক শিল্পী।